বিশেষ প্রতিনিধিঃ বকশীগঞ্জে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে প্রতিবন্ধী স্কুল স্থাপনের জন্য দৌড় ঝাপ। গত ১৫দিনে প্রায় কুড়িটি আবেদন পত্র এসেছে উপজেলা প্রশাসনের সুপারিশ নিতে।
হঠাৎ করে প্রতিবন্ধী স্কুল স্থাপনে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের নিকট সুপারিশ নিতে আসা বিষয়টি নিয়ে বিব্রতবোধ করছে উপজেলা প্রশাসন।
পরে জানাযায়, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সারা দেশে আরও ৬০৬টি স্কুল নির্মাণ হচ্ছে। এসব স্কুলে শিক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসা, পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থাসহ অন্যান্য কার্যক্রম থাকবে। বেসরকারিভাবে পরিচালিত হলেও স্কুলগুলোর শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেবে সরকার।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ লক্ষ্যে ‘প্রতিবন্ধিতাসম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা’র খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এতে স্কুল প্রতিষ্ঠা, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, পাঠদান ও পাঠ্যসূচিসহ অন্যান্য বিষয় তদারকির দিকনির্দেশনা আছে।
সম্প্রতি এ নীতিমালার ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মতামত নিয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে মাউশি পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল নির্মাণের লক্ষ্যে সম্প্রতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় খসড়া নীতিমালার ওপর মতামত চেয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় মতামত সংযুক্ত করে নীতিমালা পাঠিয়ে দিয়েছি।
সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক গাজী মো. নুরুল কবির বলেন, ২০০৯ সালের আইনের অধীনে আমরা একটি নীতিমালা করছি। মূলত প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতে এতে বিস্তারিত নির্দেশনা থাকছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে শতকরা ১৫ জন প্রতিবন্ধী। সেই হিসাবে মোট জনসংখ্যার ২ কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী। তবে দৃশ্যমান শারীরিক প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৩ থেকে ৫ শতাংশ বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে তাদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে মাত্র ১৩২টি। আর সাধারণত অধিকাংশ প্রতিবন্ধীই খোদ বাবা-মা’র হাতে অবহেলার শিকার হচ্ছে।
খসড়া নীতিমালা : প্রস্তাবিত এসব স্কুল হবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর একটি পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন কেন্দ্র। ক্লাসে পাঠদান, প্রশিক্ষণ, আসবাব এবং টয়লেট এমন হবে যা শিশুর কাছে প্রবেশযোগ্য। শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নিউরোলজিক্যাল চিকিৎসা, অডিওলজিক্যাল পরীক্ষা এবং হিয়ারিং এইডের (শ্রবণযন্ত্র) ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া ফিজিওথেরাপি, স্পিচথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, বিহেভিয়ার থেরাপি, মনোবৈজ্ঞানিক নির্দেশনা (কাউন্সিলিং), সহায়ক উপকরণ এবং শরীর চর্চার ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা বা বৃত্তি নির্বাচনের জন্য উপযোগী এবং চাহিদাভিত্তিক প্রাক-বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি উপজেলায় একটি, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তিনটি, পুরাতন জেলা সদরে দুটি, নতুন জেলা সদরে একটি বিশেষ স্কুল নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পাঁচটি করে দশটি এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দুটি স্কুল নির্মিত হবে। নতুন স্কুল নির্মাণের জন্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৫ শতক বা দুই হাজার বর্গ ফুটের ফ্লাট। জেলা সদরের জন্য ১০ শতক এবং উপজেলা পর্যায়ে ১৫ শতক জমি থাকতে হবে। ব্যক্তির নামে স্কুল নির্মাণ করতে হলে প্রতিষ্ঠানের নামে ৫ লাখ টাকা এককালীন দিতে হবে। দাতা সদস্যের জন্য এককালীন এক লাখ টাকা দিতে হবে। স্কুল নির্মাণের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোকে নির্ধারিত ফরমে সমাজ সেবা অধিদফতরে আবেদন করতে হবে। সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় স্বীকৃতি দেবে।
নীতিমালায় শহরাঞ্চলের প্রতিটি স্কুলে কমপক্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থী এবং হাওর, চরাঞ্চল, পশ্চাৎপদ এলাকা ও পার্বত্য জেলাতে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। শ্রবণ ও বাক এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হবে ১:১০। বুদ্ধি এবং সেরিব্রাল পালসি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ১:৭। অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ১:৫। সেরিব্রাল পালসি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ১:১০। অন্যান্য প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ১:১৫। এতে স্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ৫০ জন শিক্ষার্থীর স্কুলে ৬ শিক্ষকসহ ১৬ জন নিয়োগ দেয়া যাবে।
বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত এসব স্কুলে শিক্ষক ও প্রশিক্ষককে সহজভাবে, যথাযথ পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবভিত্তিক পাঠোপকরণ ব্যবহার করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের ধরন, সক্ষমতা ও বয়স অনুযায়ী প্রাক-শৈশবকালীন বিকাশমূলক কার্যক্রম (ইসিডি), প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত লেখাপড়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ১৫ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২৫ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বয়স্ক শিক্ষা ও বিনোদন কার্যক্রম থাকবে।
নীতিমালায় পাঠসূচি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। শ্রবণ ও বাক এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের শিক্ষাক্রম অনুসরণ করতে হবে। নীতিমালায় স্কুল প্রতিষ্ঠার ৬ বছরের মধ্যে সরকার নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জনের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলÑ মৃদু মাত্রার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কমপক্ষে ৫০ ভাগ প্রাথমিক এবং ১৫ ভাগ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে হবে। শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ৭০ ভাগ প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তির যোগ্য করতে হবে এবং ৬০ ভাগ এসএসসি পাস করাতে হবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ৮০ ভাগ পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণের যোগ্য করতে হবে। ৮০ ভাগ শিক্ষার্থীকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং ৬৫ ভাগ এসএসসি পাস করাতে হবে। সেরিব্রাল ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে হবে। ৬০ ভাগ শিক্ষার্র্থীকে মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি এবং ৫০ ভাগ এসএসসি পাস করাতে হবে। নীতিমালা লংঘন করলে স্কুলসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
বর্তমানে ৬৪ জেলায় একটি করে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুল আছে। এছাড়া ৭টি শ্রবণ প্রতিবন্ধী, পাঁচটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও ৫৬টি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল আছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলের মধ্যে সুইড বাংলাদেশেরই আছে ৪৮টি। রাজধানীর মিরপুরে রয়েছে ‘জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র’।
সরকারের সিদ্ধান্তনুযায়ী প্রতিটি উপজেলায় একটি করে প্রতিবন্ধী স্কুল স্থাপনে খবরে নরাচড়া করে বসেছে একটি চক্র। প্রতিবন্ধী স্কুল স্থাপনে চলছে দৌড়ঝাপ। এ কারণে তোরজোড় শুরু করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বকশীগঞ্জে ইত্যিমধ্যে ৩টি প্রতিবন্ধী স্কুল রয়েছে যা শিক্ষার্থীর অভাবে চলেছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে।