শাহ জামাল; মেলান্দহ, জামালপুর ঃ জামালপুরের মেলান্দহে হতদরিদ্রদের এক’শ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পের প্রায় ৬কোটি টাকা গচ্ছায় গেছে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে জুন ক্লোজিংকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় অর্থ নাশ করা হয়। কর্মসৃজনের প্রথম পর্যায়ের ৩৮ প্রকল্পের বিপরীতে ৩হাজার ৩শ’ ৩৯ জন শ্রমিকের দৈনিক ২শ’ টাকা হারে ৪০দিনের ২কোটি ৬৭ লাখ ১২হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। নিয়মানুযায়ী প্রকল্পের মোট টাকার (ননওয়েজ কষ্ট মাটি কাটার উপকরণ কোদাল-পাইচে ক্রয় ও প্যালাসাইডিং সম্পন্নের জন্য) ১০% হারে আরো ২৬লাখ ৭১হাজার ২শ’ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয়। এতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ দাড়ায় ২ কোটি ৯৩ লাখ ৮৩ হাজার ২শ’ টাকা।
একই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের সমহারে দ্বি-গুন বরাদ্দের পরিমান দাড়ায় ৫কোটি ৮৭ লাখ ৬৬হাজার ৪শ টাকা। প্রকল্পের অগ্রগতির খোঁজ খবর নিতে সরেজমিন ঘুরে দেখাগেছে, প্রথম পর্যায়ে হাত-গোনা দুইএকটি প্রকল্প ছাড়া; বাকি কাজ শুভংকরের ফাঁকি দিয়ে শুধু কাগজে কলমেই শতভাগ কাজ দেখিয়ে অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এরমধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের এক টাকার কাজও হয়নি। জুন ক্লোজিং অর্থ ছাড়ের জন্য শুধু অফিসিয়ালভাবেই প্রকল্প সাজিয়ে শতভাগ কাজ দেখানো হয়েছে। ফলে প্রকল্পের তালিকাও বাইরে প্রকাশ করা হয় নি। কর্মসূচিটি একমাত্র হতদরিদ্রদের জন্য হলেও; তাদের এ সুবিধাভোগ করতে দেয়নি।
প্রকল্পের টাকা নয়-ছয় রোধে ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরী প্রদানের কথা। অভিযোগ ওঠেছে, চেয়ারম্যান-মেম্বার-দলীয় প্রভাবে এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ভিআইপি শ্রমিকদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। প্রকৃত শ্রমিকদের করেছে বঞ্চিত। চেক বই শ্রমিকদের নাদিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের অসৎ পন্থায় (মেলান্দহ কৃষি ব্যাংক ব্যতিত) ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করেছে। পক্ষান্তরে উপজেলা চেয়ারম্যান-ইউএনও’-অডিটসহ অন্যান্য খরচের কথা বলে প্রকল্পের সমুদয় অর্থের ২০% টাকা পারসেন্টেস নিচ্ছেন। প্রকল্পের অগ্রগতি বিবেচনা নাকরে জুন ক্লোজিংএ অর্থ ছাড় দিচ্ছেন। অভিযোগ ওঠেছে, পিসির টাকার কেশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন-পিআইও অফিসের এক অফিসসহকারি। বাইরে বলাবলি হচ্ছে-এ ক্ষেত্রে নাকি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাও অসহায়।
লক্ষ্য করা গেছে, প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণও অস্বাভাবিক। বাস্তবতায় দেখা যায়, মাহমুদপুর ইউনিয়নের রোকনাইপাড়া তালেব আলীর বাড়ির মোড় হ’তে মাফলের বাড়ি পর্যন্ত ২শ’ শ্রমিকের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৬লাখ টাকা। ননওয়েজ কস্টের ১০% ১লাখ ৯৮হাজার টাকাসহ সর্বমোট-১৭লাখ ৯৮হাজার টাকা। এলাকাবাসী ছামিউল (৭০) জানান-৩বছর আগে এ রাস্তায় মাটি কাঁটা হয়েছে। বর্তমানে কাজ করতে দেখিনি। মাফলের বাড়ির প্রতিবেশী সালেতন (৪২) জানান-ভাঙ্গা রাস্তার সাথে আমার বসত বাড়ি ঠিকরাখার জন্য বাঁশ দিয়ে আমি নিজে মাটি আটকিয়েছি। এরইমধ্যে পাশের পাকা রাস্তার কাজে মালামাল নেয়ার জন্য ঠিকাদার নিজেও এই ভাঙ্গাতে কিছু রাবিশ ফেলে চলাচল উপযোগী করেছেন। এরপর একদিন কয়েকজন শ্রমিককে রাস্তার উচু-নিচূ কেটে লেভেল করতে দেখেছি। মজার বিষয় হচ্ছে-তালেবের বাড়ি থেকে মাফলের বাড়ির দুরত্ব হবে প্রায় ৪শ ফুট। এতে প্রতি ঘনফুট মাটিকাটার খরচ পড়েছে ৪হাজার ৪শ’ ৯৫ টাকা। প্যালাসাইডিংএর গন্ধও নেই। তালেব আলী জানান-৫/১০ হাজার টাকার মাটি কাটলেও দৃশ্যমান হতো।
আদ্রা ইউনিয়নের পশ্চিম আদ্রা ছাবেদের বাড়ি হতে মোড় হতে বাদশার বাড়ি পর্যন্ত মাত্র ২শ’ ফুট এবং একই গ্রামের নূরুলের বাড়ি হতে পাকা রাস্তা হতে হযরতের বাড়ি পর্যন্ত দুরত্ব প্রায় দেড় শ’ ফুট। মাটি কাটার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে-৩লাখ ৯২ হাজার টাকা। এতে প্রতি ঘনফুট মাটিকাটার খরচ দাড়ায় ১হাজার ১শ’ ২০ টাকা। দেখাগেছে, বাদশা বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার পাশে বসতী। এখানে মাটি কাঁটা কিংবা মাটি ভরাটের মতো স্থানই নেই। নূরুলের বাড়ির পাকা রাস্তার মোড় থেকে হযরতের বাড়িটি দাঁতভাঙ্গা নদীর তীরবর্তী মাত্র ৩টা বাড়ি। এখান দিয়ে দু’পায়ে চলাচল করতে হয়। এখানে কোন মাটি কাটার কোন পরিবেশ-মাটি কাটার চিহ্নও নেই। এ ব্যাপারে আদ্রা ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল করিম ফরহাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জোরগলায় বলেন-আমি কাজও করেছি। টাকাও তুলেছি। তবে শ্রমিক দিয়ে নয়।
উপজেলা চেয়ারম্যানের নিজ গ্রাম-নাংলা ইউনিয়নের চারাইলদার বাজারের পশ্চিম পাশে ব্রীজ থেকে চারাইলদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত দুরত্ব হবে প্রায় ৫/৬শ ফুট। এরমধ্যে ঈদগাহ মাঠ আছে। ঈদগাহ মাঠে মাটি কাটতে হবে না। এতে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৫লাখ ৬২হাজার টাকা। স্থানীয় কৃষক রাজা মিয়া (৪৫) বলেন-শুধু ব্রিজের পাশে সামান্য মাটি ফেলা হয়েছে। শুনেছি আমারও নাম শ্রমিক তালিকায় আছে। সত্যতা জানার চেষ্টা করলে আমাকেও কিছু টাকা দিয়েছে। আমি কাজও করিনি। এভাবেই উপজেলা চেয়ারম্যানের আত্মীয়দের দিয়ে শুধু টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। নাংলা ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান মাফল জানান-আমি টাকা উত্তোলন করলেও; পরে কাজ করব। কিছু করাচ্ছি। অন্যরা তো কিছুই করে নি।
উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ হাবিবুর রহমান চাঁনের বিয়াই চরবানিপাকুরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন ভুট্রোর এলাকায় বেতমারী দক্ষিণ পাড়া পাকা রাস্তার মাথা থেকে দক্ষিণপাড়া প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ননওয়েজ কস্টসহ মোট ১০ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এ রাস্তার দুরত্ব প্রায় কোয়ার্টার কি:মি:। সরেজমিন ঘুরে দেখাগেছে, এ রাস্তার মাটি কাটার প্রয়োজনই নেই। এর চেয়েও অবহেলিত রাস্তা প্রকল্প হওয়া উচিত ছিল। এ গ্রামের আ: আজিজ মাস্টার জানান-শুনেছি বরাদ্দ নাকি ৭০ হাজার টাকা। ৩০হাজার টাকার চুক্তিতে শ্রমিকদের রাস্তা চাছা-ছোলা করতে দেখেছি। এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ একেএম হাবিবুর রহমান চাঁনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন-আমি একটি বোর্ড মিটিংএ আছি। পরে কথা হবে বলেই ফোন কেটে দেন।
ফুলকোচা ইউনিয়নের হাজরাবাড়ি সিএন্ডবি রাস্তায় রহিমের দোকান থেকে গুজাদহ বিল পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৮লাক ৪৪ হাজার টাকা। সরেজমিনে দেখাগেছে, রাস্তাটি সম্পূর্ণ সচল। মাটি কাটার প্রয়োজনই হয়নি। তবে শাহজাহানের দোকানের সামনে একটু নিচু স্থান। এখানেও কোন মাটি ফেলানো হয়নি। ব্রাহ্মণপাড়া শাহজাহানের বাড়ি থেকে ফরিদ মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত ঝকঝকে রাস্তার দুরত্ব হবে সর্বোচ্চ ৩/৪শ’ ফুট। এই রাস্তার মাটি কাটার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৮লাখ ৪৪ হাজার টাকা। রাস্তার মাথায় গাছে টাঙ্গানো সাইনবোর্ডে উপর্যুক্ত বরাদ্দের পরিমাণ লেখা আছে। বিলের তীরে সর্বোচ্চ ১/২হাজার টাকার মাটি কাটার কথা স্থানীয়রা জানান। ফুলকোচা ইউপি চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বাবু জানান-রাস্তা সচল ছিল না। দুই মাস আগে মাটি কেটেছি। এখনো কী মাটি থাকবে? মাটি কাটলে রাস্তার পাশের মাটির গর্ত নেই কেন? এমন প্রশ্নে বাবু বলেন, ভাই পরে আমার সাথে দেখা কইরেন। বাস্তবতা হচ্ছে-প্রতিটি প্রকল্প সরেজমিন তদন্ত করলে এমন চিত্র পাওয়া যাবে।
প্রকল্পের সার্বিক বিষয়ে ইউএনও জন কেনেডি জাম্বিল এবং উপজেলা আ.লীগের সভাপতি আ: রাজ্জাক সুজার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে; সুজা ইউএনও’র সামনাসামনি বলেন-এত লুটতরাজের বিষয়টি আমিও জানি না। উত্তরে ইউএনও সুজাকে লক্ষ্য করে বলেন-সরকারি কর্মকর্তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ এবং সহযোগিতা করে দেখুন। ফলাফল কী পান। বাস্তবতা হচ্ছে-উপজেলা চেয়ারম্যানের কথায় সব ফাইল পাশ করে দিতে হয়। এ কথা তো কেউ বলেন না? আমি কী করব? তবে অস্বাভাবিক বরাদ্দের বিষয়ে পিআইও/ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা বলেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আ: রাজ্জাক জানান-সমস্যাটা হচ্ছে; সঠিক সময়ে প্রকল্প দাখিল নাকরায় তদারকি করা সম্ভব হয়না।
উপজেলা আ.লীগের যুগ্ম সম্পাদক এমদাদুল ইসলাম জানান-সাধারণ শ্রমিকের মুখের আহার কাড়া বন্ধে দলের অবস্থান পরিস্কার। এ ব্যাপারে মাননীয় পাট-বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মির্জা আজম এমপি সরকারি কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। কোন অনিয়ম বরদাশত করবেন না। বিগত দিনে দলীয় লোকদের দোহায় দিয়ে লুটতরাজ চলতো। এবার দলীয় নেতা-কর্মীরাও কোন ডিস্ট্রার্ব করছেন বলে জানানেই। কোন অজুহাতে লুটপাট চলে? প্রয়োজনে দলীয়ভাবে মোকাবেলা করা উচিত। সচেতন মহলের প্রশ্ন বিগত দিনে প্রকল্পের দুর্নীতি-অনিয়মের দায়ে কীয়দাংশ অর্থ সরকারের কোষাগারে ফেরত দেয়া হতো। কিন্তু এবছর তাও নেই। এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।