গোলাম রাব্বানী নাদিমঃ কয়েকদিন যাবত লেখব লেখব ভাবছি, শিরোনামটাই খোজে পাচ্ছিলাম না। কি দিয়ে শুরু করব, কোথায় থেকে শুরু করব, আর কিভাবে শুরু করব। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখব, কি লেখব। তাকে নিয়ে তো লেখার শেষ নেই। গত জুলাই মাসের ১১ তারিখে ঢাকা সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে গিয়েছিলাম। সেদিন একজন আইনজীবির মৃত্যুর জন্য তার সম্মানে র্কোটের কাযক্রম বন্ধ ছিল। খবরটা শোনেই দ্রুত কোর্ট প্রাঙ্গন ত্যাগ করি। পরে ভাবলাম কি করা যায়, পরে রওনা দিলাম মোহাম্মদপুর এর উদ্দেশ্যে। বাস থেকে নামলাম কলাবাগান লেকসার্কাস এলাকায়। একটু হাটতে ছিলাম, চোখে পড়ল ধানমন্ডি ৩২। রাস্তার মাথায় লেখা ধানমন্ডি ৩২। এই ধানমন্ডি ৩২ এর নাম বহুবার শোনেছি কিন্তু দেখা হয়নি। ৩২ নাম্বার দাড়িয়ে পশ্চিম দিকে তাকালাম দেখলাম অনেক মানুষের ভীর। একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানার চেষ্টা করলাম, কি সেখানে? আগান্তু পথিক জানালেন, সেখানেই তো বঙ্গবন্ধুর বাড়ী ছিল, বর্তমানে যাদুঘর। কৌতুহলে আরও বেড়ে গেল। একটু একটু এগোতে থাকলাম, দুই পাশ্বেই পুলিশের কড়া পহাড়া। পরে আমার পথ নিরিবিচ্ছন্ন করতে সাংবাদিকের পরিচয় পত্রটি গলায় ঝুলিয়ে দিলাম। পরিচয় পত্রটি আমাকে চলার পথ নিরিবিচ্ছিন্ন ভাবে পৌছে দিল সেই ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের অবস্থিত বাড়ীর সামনে। রাস্তার বামদিকে বঙ্গবন্ধু ভাসকার্য। বিপরীতেই সেই ঐতিহাসিক বাড়ীটি। কিভাবে ঢুকবো এই নিয়ে নানান প্রশ্ন উকি, ঝুকি দিচ্ছে মনের ভিতরে। পরে এক নিরাপত্তাকর্মীর সহযোগীতায় টিকিট কাউন্টারে গেলাম। ৫টাকা বিনিময়ে একটি টিকিট কাটার পর ঢুকলাম বাড়ীর ভিতরে।
এই বাড়ী সম্পর্কে কি আর লেখব বাংলাশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সাক্ষী। এই বাড়ি বঙ্গবন্ধুর। ৩২ নম্বরের সেই বাড়িটি বাংলাদেশ জন্ম ইতিহাসের সূতিকাগার। বাড়িটিকে একখণ্ড বাংলাদেশও বলা যায়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বাড়িটি তীর্থস্থান হিসেবেই বিবেচিত হবে।
কেউ যদি বলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যান, তাহলে বুঝতে হবে তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যাচ্ছেন। আর বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়া মানেই বাংলাদেশের কাছে যাওয়া। ৬০ এর দশক থেকে বাড়িটি একটি প্রতীক হয়ে আছে। আর সে প্রতীক হচ্ছে সাহস, দৃঢ়তা ও বিদ্রোহের।
এই বাড়িকে অবলম্বন করেই স্বাধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত। আর এ বাড়ি থেকেই তিনি দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। সারাদেশের মানুষ প্রতিটি রাজনৈতিক নির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িটির দিকে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ এর নির্বাচন পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের সময় এই ৩২ নম্বরের সামনে ভিড় জমে যেত। সবাই নেতার নির্দেশের অপেক্ষায় প্রহর গুনতেন। কখন বঙ্গবন্ধু তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন সেই প্রত্যাশায় দিন কাটতো মুক্তিপাগল বাঙালির। যেন বাঙালির প্রাণভোমরা এইখানে, এই বাড়িতে।
বাঙালির প্রাণের, প্রেরণার উৎস যে এই বাড়িটি তা খুব ভালো বুঝেছিল স্বাধীনতার শত্রুরা। তাই ’৭৫ এ এই বাড়িতেই হামলা করে তারা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। শিশু রাসেলও রক্ষা পায়নি ঘাতকদের হাত থেকে। তারা জানতো বঙ্গবন্ধুর পরিবারের একজন সদস্য বেঁচে থাকলে তাদের চক্রান্ত ভেস্তে যাবে। গেছেও। অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। কিন্তু সেই চক্রান্তকারীদের বিচার হয়েছে।
১৯৭৫ সালে যেমন ছিল
প্রফেসর ইমেরিটাস আনিসুজ্জামান বলেন, এই বাড়িটির সবচেয়ে বড় গুরুত্ব হচ্ছে ১৯৭১ সালে। তখনকার অসহযোগ আন্দোলন এ বাড়িকে ঘিরেই পরিচালিত হচ্ছিল। ৩২ নম্বরের বাড়িটি জাতির স্পন্দনের কেন্দ্রে ছিল। পরে বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতেই নিহত হন। সেটা আরেক স্মৃতি। বঙ্গবন্ধুর বাড়িটিকে ৩২ নম্বর যাতে না বলা যায় সে জন্য বাড়ির নম্বর বদলে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু ৩২ নম্বর বললে মানুষ বঙ্গবন্ধুর বাড়িকেই বুঝে। মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই মনে রেখেছে। ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না, সেটা বোঝা দরকার।
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। ধানমন্ডির লেক সার্কাসের পাশে ৩২ নম্বরে গেলেই দেখা মিলবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি। এই বাড়িতেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সপরিবারে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সড়ক-৩২, বাড়ি নম্বর-৬৭৭ আর নতুন ঠিকানা অনুযায়ী ধানমন্ডির সড়ক নম্বর ১১ আর বাড়ি নম্বর ১০। বাংলাদেশের মানুষের কাছে বাড়ির পরিচয় ৩২ নম্বরের বাড়ি।
ধানমন্ডির এই বাড়ি বাঙালির আশা-আকাক্ষা ও দ্রোহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এখন সেই বাড়িটি বাঙালির তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অর্জন করেছে অমরত্ব। এই বাড়ি সম্পর্কে জানলে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস জানা হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে এই বাড়িতে বসবাস করা শুরু করেন।
১৯৬৬ সালের দিকে যখন ৬ দফা জোরালো হতে থাকে তখন থেকেই বাড়িটির ভাবমূর্তি আরও বাড়তে থাকে। তখন মানুষ ওই বাড়ির সামনে এসেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতেন। ১৯৭০ সালের পর ওই বাড়ির গুরুত্ব আরও অনেক বেড়ে যায়। সকাল-বিকাল-রাত সবসময়ই জনসমাগম থাকত। সেই ১৯৬২ সালের আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ’৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন– এসব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক পরিকল্পনা করা, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সবই করেছেন এই বাড়িতে। ’৭১-এর উত্তাল দিনগুলোয় দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও জাতির জনকের সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে ভিড় করতেন।
এ ছাড়া ৭ মার্চেও সেই ঐতিহাসিক ভাষণের রূপরেখাও এ বাড়িতেই তৈরি করেছিলেন শেখ মুজিব। ৩২ নম্বরের বাড়িটি ছিল দেশের মানুষের জন্য অবারিত দ্বার। সাধারণ মানুষজন সবসময়ই তার কাছাকাছি যেতে পারতো। তিনি সবার দুঃখ কষ্ট মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, রাজনৈতিক বিভিন্ন মিটিং সব তিনি এখানে থেকেই করতেন। এই বাড়ি থেকেই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে অসংখ্যবার গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
ইতিহাসঘেরা এ বাড়িটি ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত সামরিক কর্তৃপক্ষ দখল করে রাখে। পরে ১৯৮১ সালেই বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বাড়িটি ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১৯৯৪ সালের ১১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠনের পর বাড়িটিকে ট্রাস্টের অধীনে দেয়া হয়। পরে ট্রাস্ট বাড়িটিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরিত করে।
বাড়িটির মূল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না করেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার্য বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সাজানো হয়েছে জাদুঘর। আছে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র। বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে জানতে হলে দেশের সব নাগরিককে একবারের জন্য হলেও এখানে আসতে হবে।
তিন তলা বাড়ির ভবনে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বলা যায়, এক তলার প্রথম কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধু ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তোলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এ তলায় আরো আছে পরিবারের নিহত অন্য সদস্যদের তৈলচিত্র। দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। ১৫ আগস্ট ভোরে বেগম মুজিব, জামাল, কামাল, রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূর রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানে পড়েছিল। আর এ ঘরের সামনে করিডোর থেকে নিচে যাওয়ার জন্য যে সিঁড়ি সেখানেই ঘাতকদের গুলিতে মারা যান বঙ্গবন্ধু। এখনো গুলির স্পষ্ট চিহ্ন সেখানে রয়ে গেছে। সিঁড়িটি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
স্মৃতি জাদুঘর
বঙ্গবন্ধুর মরদেহ যেখানে পড়েছিল সেই জায়গাটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে তার বিছানার পাশেই ছোট টেবিলে সাজানো আছে তাঁর সবসময়ের সঙ্গী পাইপ, তামাকের কৌটা। এ কক্ষে আরো আছে টেলিফোন সেট, রেডিও। কিছু রক্তমাখা পোশাক। সামনের খাবার ঘরের পাশেই আছে শিশু রাসেলের ব্যবহার করা বাইসাইকেল। উল্টো দিকে শেখ জামালের কক্ষে দেখা যায় তার সামরিক পোশাক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কক্ষও একই তলায়। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষ। এ কক্ষে তার বিভিন্ন সংগীতযন্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে। বাড়ির রান্নাঘরের হাঁড়িগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজানো।
এ ভবনের মোট নয়টি কক্ষে বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে আরো আছে বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, শিশুপুত্র রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবহার্য আসবাবের মধ্যে আরো আছে খাবার টেবিল, টেবিলের ওপর থালা, বাটি। আছে সোফা। বাড়ির দেয়াল, দরজায় বিভিন্ন জায়গায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বীভৎসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার করে।
জাদুঘরের পেছনের অংশে রয়েছে সম্প্রসারিত নতুন ভবন। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট এ অংশটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হয়। ছয় তলা ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র রয়েছে আর পঞ্চম তলায় পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র।
স্ত্রী সন্তানদের জন্য স্মৃতি বয়ে এনেছি কিছুই আনতে পারি নাই। কারণ সেখানে ক্যামেরা বা মোবাইল নিয়ে যাওয়াতে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কারণ জানতে চাইলে এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, এখানে সবার জন্য উন্মুক্তো । সাবাই আসুন, সবার জন্য উন্মুক্ত। তাই এখানে ছবি তোলতে দেওয়া হয় না।