গোলাম রাব্বানী নাদিম ঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহাম্মেদ, বীর প্রতীক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে এক অনবদ্য নাম। প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে জীবনের সমস্ত মায়া ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ চিঠি নিয়ে শত্রু ব্যাংকারে ঢুকে পড়েন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেছেন অবিচল।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে যে স্বপ্ন নিয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তা আজও পুরণ হয়নি বলে হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, শোষনমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আজও আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি না। আজ যেখানে যাবেন সেখানেই ঘুষ ও অনিয়ম।
এক চোখে হতশার সাগর অন্য চোখে আশার ঝিলিক, রাজাকার সাকা চৌধুরী, মীর কাশেম আলী ও কাদের মোল্লা ফাঁসি হওয়ায় তিনি যেমন আনন্দিত, অন্যদিক অন্যান্য রাজাকারের বিচার না হওয়ায় তিনি হতাশ। শেষ জীবনে একটাই চাওয়া প্রত্যেক রাজাকারের উপযুক্ত বিচার।
এতদিন এই দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন লোক-চক্ষুর আড়ালে। কখনও সংবাদকর্মীর সাথে কথা বলতে চাননি। বর্তমানে তিনি মাঝে মধ্যেই নতুন প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান, কথা বলেন মিডিয়ার সাথে।
বিডিআর, বর্তমানে বিজিবিতে দীর্ঘ ৩০ বছর চাকুরীকরে সম্প্রতি অবসরে এসেছেন। বর্তমানে সময় কাটে বই পড়ে, সংসারের অন্যান্য কাজ করে।
ব্যক্তিগত জীবনে ৩জনের জনক এই বীর মুক্তিযোদ্ধার ২সন্তান ইতিমধ্যেই সরকারী চাকুরীতে যোগ দিয়েছেন। ছোট ছেলে বর্তমানে শেরে কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র।
কথা হয় তার সাথে, দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার অনুভুতি, প্রাপ্যতা ও না পাওয়া কথা গুলির চম্বুক অংশ আজ পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলঃ ছবি তুলে সহয়তা করেছেন রশিদুল ইসলাম রনি স্বাক্ষাতকারে গোলাম রাব্বানী নাদিম ও আশরাফুল হায়দার।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জঃ মুক্তিযুদ্ধে গেলেন কেন?
বশির আহাম্মেদঃ ভারত-পাকিস্তান দুটি দেশ বিভক্তির পর থেকে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর বিমাতাসুলভ আচারণ করে আসছিল। দিন দিন আমরা পিছিয়ে পড়ছিলাম। আমাদের সকল অধিকার আস্তে আস্তে কেড়ে নিচ্ছিল পাকিস্তানিরা। একটি মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আমাদের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। আর নিজেদের অধিকার রক্ষা করতেই আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জঃ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন?
বশির আহাম্মেদ ঃ সে সময় জীবন মৃত্যুর কোন চিন্তা ছিল না, চিন্তা একটাই দেশকে স্বাধীন করতে হবে।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জঃ কবে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে?
বশির আহাম্মেদঃ ৭১সালের মে এর প্রথম সপ্তাহে বাড়ী থেকে বের হই। পরে প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জ ঃ মুল যুদ্ধ কবে থেকে শুরু হয়?
বশির আহাম্মেদঃ মুলত জুলাই থেকেই মুল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। জুলাই থেকে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পর্যন্ত ১১ নং সেক্টরে প্রতিদিনই কোন না কোন ফ্রন্টে যুদ্ধ হয়।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জ ঃ ৪ তারিখে কি হয়েছিল?
বশির আহাম্মেদ ঃ ৪ তারিখ সকালে ভারতের বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিং ক্লিয়ার একটি আত্মসমর্পনের চিঠি লেখেন, অনেককে বললে কেউ যেতে রাজী হয়নি। পরে আমাকে চিঠি দিলে সেই চিঠি নিয়ে আমি পাকিস্তানের ব্যাংকারে ঢুকে পড়ি।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জ ঃ কিভাবে ঢুকলেন?
বশির আহাম্মেদ ঃ চিঠির সাথে সাদা একটি ফ্লাগ ছিল। আমি যখন এক হাতে চিঠি ও অন্য হাতে একটি ফ্লাগ প্রদর্শণ করি তখন পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে ব্যাংকারে নিয়ে যায়।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জ ঃ তারপর?
বশির আহাম্মেদঃ প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্ত মনোবল ছিল অটুট। তখন সকাল ৮। চিঠিটি নিয়ে যখন ঢুকি, তখন সুবেদার মেজর র্যাঙ্ক ধারী আমাকে ব্যাংকারে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখে। তবে তারা কোন খারাপ আচারণ করেনি। পরে ৩টার দিকে সঞ্জু নামে আরেক মুক্তিযোদ্ধা অপর আরেকটি চিঠি নিয়ে গেলে তাকেও আমার সাথে বসিয়ে রাখে। এ সময় ভারতীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমান আকাশে বেশ কয়েকবার চক্কর দেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর উপর বোম বর্ষণ করলে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী সেনা আহত হয়। পরে আমরা সাদা ফ্লাগ নিয়ে মাঠে যায়, সেখানে গিয়ে তা দেখালে বিমানগুলো চলে যায়।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জ ঃ এরপর?
বশির আহাম্মেদ ঃ ক্যাপ্টন আহাছান মালিক আরেকটি চিঠি দিয়ে ফেরত পাঠায়। আমি চিঠি নিয়ে হরদেব সিং ক্লিয়ার নিকট জমা দিলে তিনি আরেকটি চিঠি আমাকে দেয়। আমি অনুরূপভাবে ২য় চিঠি নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর নিকট গেলে আত্মসমর্পনে রাজী হয় পাকসেনারা।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জ ঃ কিভাবে আত্মসমর্পন করল?
বশির আহাম্মেদঃ ২য় চিঠি নিয়ে যাবার সময় ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা আমার পিছনে এগুতে থাকে। ২য় চিঠি পাওয়ার পর ক্যাপ্টেন আহাছান মালিক ব্যাংকার ছেড়ে মাঠে এসে ভারতীয় বাহিনীর সাথে কথা বলে আত্মসমর্পনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এসময় বিপুল পরিমান পাকিস্তানী সৈন্য বর্তমান কামালপুর হাইস্কুল মাঠে তাদের অস্ত্র জমা দেয়। পাকিস্তানী সৈন্যদের বেশ কয়েকটি ট্রাকে করে ভারতের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হয়।
সাপ্তাহিক বকশীগঞ্জ ঃ এ সময় কেমন লেগেছিল?
বশির আহাম্মেদঃ ওই সময়ের অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। হাসতেও পারি নাই, কাঁদতেও পারি নাই। ৪ ডিসেম্বর যখন আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্বাধীন পতকা উড়াই তখন জয় বাংলার শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছিল বাংলার আকাশ।
এভাবেই একটি মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা দিলে বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহাম্মেদ বীর প্রতিক।